আমার নগর আমি আর হতাশা। এই তিনে মিলে বেশ জবরদস্ত মোটাদাগের রূপরেখা তৈরী করে চলেছে। তবু নানান বিষয়ে প্রশ্ন বিশুদ্ধ এই নগর প্রতিবাদহীন কুর্নিশ জানিয়ে চলেছে অনবরত। এখানের এটাই নিয়ম। হয়তো এই একই আদলে চলছে দেশের অনেক স্থান। যেহেতু জানি না তাই অনুমান করাও সম্ভব নয় একেবারেই। নগর সত্যতার অগ্রযাত্রা কিংবা পশ্চাদপদতা বোধ করি এ ভাবেই এগিয়ে চলে। কিংবা বলা যায় চলতে বাধ্য হয়। অনবরত রাস্তাগুলির সংকোচনকে সম্প্রসারণ করা হয়। উন্মুক্ত জলাশয়গুলি ক্রমশ প্রথমে মাঠ, কিছুদিন যেখানে খেলাধুলা, তারপরে একসময় বিশাল ইমারত। রাস্তায় ঠেলা, ভ্যান করিমন, নসিমন, রিক্সা অটো আর বাহারী গতির অযাচিত ভিড়ে চিড়ে চ্যপ্টা নগরবাসী। সাধারনের নাভিশ^স, তবু তারা নির্বিকার। কোথাও তাদের একাত্মতা নেই, পারস্পারিক নেই বিন্দুমাত্র বিশ্বাস। আছে কেবল সুবিধা ভোগের বেলাল্লা উল্লাস।
আরো আছে রাজনীতির অরুচিকর প্রভাবের বিস্তার। অনেকটা ক্রমশ প্রসস্থ ড্রেনগুলির সংকোচিত করে মাথায় ঢাকনা দিয়ে আর্বজনা দুর্গন্ধ এড়ানোর ব্যর্থ প্রয়াসের মতো। মশার স্বাধীন বিচরণে সঠিক বিরোধীতার অভাব স্বতসিদ্ধ ছিল, আছে, সম্ভবত থাকবে। কারণ যাকে পরিবর্তন বলি কিংবা ভাবি অনেক আশার পরেও পরিবর্তিত প্রত্যাশা পুরন হবে, সে গুড়ে সম্ভবত বালি-ই মিলবে। কারণ স্পষ্ট। প্রত্যাশা পুরনের যে ভাব ও রূপের বহি:প্রকাশ আপাতত দেখছি সে মেধাদীপ্ত নয় এখন প্রর্যন্ত। মানুষ কি চায়? প্রসস্ত রাস্তা, সুন্দর বাগান, পরিষ্কার ড্রেন, পরিষ্কার জলাশয়ই শুধু? না কি ছোটকরে হলেও প্রত্যাশা থাকে নাগরিক সম্মানের? যে সম্মান বিগত দিনগুলিতে গুটিকয়েক অর্বাচিন ব্যতিত বাকিদেরটাকে প্রায় নাই করে দিয়েছিল।
সেই ভাবনারই বিস্তার দেখা গেলো ২০২৩ সালের বিজয় দিবসে। এই শহরের বিস্ময় মেয়র আসবে শহীদ মিনারের আয়োজনে। আয়জোকদের অপেক্ষাকে প্রলম্বিত করেও শেষ পর্যন্ত তিনি এলেন না। তার শহীদ মিনারে বিজয়ের আয়োজনে অনুপস্থিতির খবর বিস্তারিত হলো জনে জনে। জন্ম দিলো নানান প্রশ্নের। কেউ কেউ বলেছে এখানেও হয়তো মিলবে একই আদলেরই ভিন্নরূপ! খুব কিছুর প্রতাশ্য না থাকাই ভালো। অবাক হয়েছি, নগরবাসীর এমন কথায়। প্রশ্ন জেগেছে আরো অনেক মনে। তাহলে কেন খামাখা এই পরিবর্তন? মাকাল-ই যদি হবে ফলের নাম, তবে তার জন্য এতো পক্ষ বিপক্ষ কেন? রাজনীতি যদি সংস্কৃতির ধারণাকে ধারণ করতেই না পারে, তা হলে সেটা কিসের রাজনীতি? শুধু বাড়ি গাড়ি আর ঝকঝকে রাস্তার যে রাজনীতি, তার শেষ পরিনাম সেতো এই শহরে সবার মুখস্ত। যদিও সে পরিনামের কোন দায়ভার আমাদের কারোই নয়। যে হাতে তার নির্মাণ, ঠিক সেই একই হাতে তার নাই হয়ে যাওয়ার এই ব্যর্থ পরিনাম। আমরা শুধু কেউ কেউ ছিলাম কেবল সেই গতির পরিনতিকে তরান্বিত করবার গতিময় উপকরণ মাত্র। যা এমনো এক দু:খের আক্ষানকেই প্রলম্বিত করে চলেছে। দেখলাম সেই একই পথের অবধারিত পথিক হলেন মাননীয় মন্ত্রী মহাদয়ও। মহাত্মা অশ্বিনী কুমার স্মৃতি সংসদের আয়োজনে অশ্বিনী মেলায় থাকবার সম্মতি প্রদান করেও এলেন না। মেলায় উপস্থিত অশ্বিনী প্রেমিরা যারপর নাই বিস্মিত হয়েছেন। প্রশ্ন তুলেছেন নিজেরাই নিজেদের কাছে ‘কাকে ভোট দিলাম, কেনো?
জানি এই পরিনামের পিছনে রাজনীতির মানুষদের ব্যাপক প্রাপ্তিযোগের গল্প এখন শহরময়। সে সবথেকে দু:খের বিষয় এখন, সংস্কৃতির মানুষদের নামও । যাদের একমাত্র দায় ছিলো বিপর্যয় এড়াণোর সরল পথ দেখানোর। সরব সত্য উপস্থাপন। কারো দাসত্ব নয়। অথচ ভুল করে হলেও সকল সংস্কৃতির নেতার সেটি না করে নিজেদের ‘কি হনুরে’ রূপ নির্মাণের পথে চলতে বাধ্য করেছেন। অমাদের এই দু:খ এই অধগতি সহজে পুরণীয় নয়। আমাদের এই উপ-মহাদেশের রাজনীতির সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ক্ষমতা, দম্ভ এবং সার্বিক অসভ্যতার বহি:প্রকাশ ঘটানো। এবং জনগণকে সার্বিক নিয়ন্ত্রণে নেওয়া। তার জন্য যা যা কিছু করণীয় সকল কিছু করতেই তারা বদ্ধপরিকর। যদিও রাজনীতিবিদদের এই পথের রাস্তায় লাল গালিচা পেতে স্বাগত জানান ঐ অতি সুবিধাভুগী বোকা জনগণই। যারা মেয়রের পাশে দাঁড়ালেই নিজেকে মেয়র ভাবে, মন্ত্রীর পাশে দাঁড়ালে ভাবে মন্ত্রী। আর ডিসি এসপির গাড়ি দেখলেও ছালাম ঠুকে। বাড়ি গিয়ে স্ত্রীকে ভাব নিয়ে বলে ডিসি সাহেব আমার নাম ধরে ডেকেছে আজ। এও এক বোকা অহংবোধ। যা মানুষকে পাঠা যোগ্যতায় রূপন্তরিত করে। যাদের মাথার উপর অনবরত ছড়ি ঘুড়িয়ে যে কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া যায়। এ ব্যাপারে রাষ্ট্র এবং রাজনীতি সবাই এক এবং অভিন্ন।
একটি ছোট উদাহরণ, সদ্য বিদায়ী মেয়র কর্পোরেশনের বেশ কিছু কর্মকর্তা কর্মচারীকে তাদের অস্বচ্ছ কাজের দায়ে বরখাস্ত করেছিলেন। সেই সকল অস্বচ্ছতা নিরুপনের মাপকাঠি কতটা স্বচ্ছ যোগ্য ছিল, সে প্রশ্ন থাকতে পারে ভুক্তভোগীদের কাছে। কিন্তু কেউ প্রশ্ন তোলেননি। তাতে কি প্রমাণিত হয় যে, সবাই দুধে ধোয়া কিংবা দোষী? কোন কোন পরিস্থিতি থাকে যখন সত্য উচ্চারণে, জিহ্বা খসে পড়বার উপক্রম হয়। বিদায়ী মেয়রের পাঁচ বছরটা অনেকটাই তেমন আদলের ছিল বলে এক ধরণের প্রচলিত কথা আছে শহরে। সেই সময় যারা বরখাস্ত হয়েছেন তাদের অনেকের সাথেই এই শহরের অনেকের সুসস্পর্ক ছিল কিংবা আছে এখনো।
সেই বরখাস্ত কর্মচারী কর্মকর্তাদের সবার কিছু না কিছু প্রাপ্তিযোগ হয়েছে বর্তমান নির্বাচিত মেয়রের কৃপায়, তার হাত ধরে। এ প্রত্যাশা ছিল সবার যারা প্রাণভরে তাকে ভোট দিয়েছেন তাদের। এই শহর নির্বাচনের পোস্টার দেখেই মন্তব্য করেছেন অনেকে, ‘সে মেয়র হলে ভালো হবে।’ তার চেহারায় এবং কন্ঠস্বরে অন্তত কোন রুক্ষতা নেই। নিশ্চয়ই বিচক্ষণতার প্রমাণ মিলবে তার কাজে। আমরা দেখলাম শুনলাম সেই প্রত্যাশিত ধারাবাহিকতায় কে বা কারা যেন শুরুতেই কলিমা লেপনে উদ্যেগী হয়েছে। সেই বরখাস্তকৃতদের মধ্য থেকে মাত্র একজনকে বাদরেখে সবাইকে গ্রহণ করেছে কর্পোরেশন। এটা কেন কি কারণ। ওর রাজনীতির দৃষ্টিভঙ্গী শুদ্ধ নয়? ওর নৈতিকতা কিংবা অনৈকতা কি সবার থেকে আলাদা? ওকি বিগত পাঁচ বছর সকলের মতো কষ্টে ছিল না? হ্যা শুনেছি কিছু দোষ তার আছে। ছাত্র জীবনে ছাত্রলীগ করেছেন, এক সময় বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের সম্পাদক ছিলেন, ছিলেন ব্রজমোহন থিয়েটারের প্রথিষ্ঠাতাদের একজন। সকল আওয়ামী নেতাদের সাথে সুসম্পর্ক রেখেছেন। সর্বোপরি মেয়র হিরণের আস্থাভাজন হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। তাই কি আজকে তার এই পরিনাম?
মাননীয় মেয়র, হয়তো আপনার সিদ্ধান্তই সঠিক। তার পরেও বলি গেল পাঁচ বছর যে বাইরে থাকলো এ পাঁচ বছরও যদি বাইরেই থাকতে হয়। তা হলে মানুষ বলে বসতে পারে ভিন্নতার কি দেখলাম? এই শহরে আপনি প্রধান মন্ত্রীর চতুর্থ উপহার। প্রথম শওকত হোসেন হিরণ। দ্বিতীয়, কর্নেল-শামীম, মাননীয় মন্ত্রী। তৃতীয়, সাবেক মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ এবং চতুর্থ, আপনি। আজও যদি কে কার লোক ছিল এই হিসেবে চলে তাহলে তো কম্বলের লোম উজার হয়ে যাবে!
আজ আপনাদের চারপাশে যারা তাদেরও এক বছর পূর্বের ঠিকানায় কার নাম লেখা? এই সত্য এখন অসত্যের দখলে। যার বিস্তারিত প্রভাব কঠিনভাবে পড়েছে বরিশাল সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও। যে অঙ্গনের জনা দশেক মানুষ মূলত যারা সংস্কৃতির বোধ শূন্য। কেবল ক্ষমতা, পয়সার আনুগত্য প্রয়াসী, এবং মূলত ভীতু। কেবল মঞ্চের আসন ভিখারী। তাদের সীমাহীন এই অযোগ্যতায় আজ এই শহরের সংস্কৃতি চর্চার অতীত ঐতিহ্য ধুলার মলিন। রাজনীতির মতো সেখানেও পরাজিতের দিকে বিজয়ীদের ক্ষুদ্ধ দৃষ্টি। এই কি বাঞ্ছিত ছিল? আজ রুদ্র প্রতাপী সেই মানুষগুলো শিশুদের আদেশ নির্দেশ মেনে তবুও মঞ্চারোহী হচ্ছে। এই অসভ্য অযোগ্যতার খেসারত আমাদের গুনতে হবে আরো অনেকদিন। ইতিমধ্যে প্রশাসন এবং রাজনীতি সংস্কৃতি অঙ্গনের বর্তমান এই বিভাজনের দুর্বলতাকে গ্রহণ করছে। যে কারণে না মেয়র, না মন্ত্রী, না প্রশাসন। না তারা কেউই এখন পর্যন্ত সংস্কৃতি কর্মীদের সাথে সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হবার কোন তাগিদ অনুভাব করছেন না। ঠিক জানি না রাজনীতিকে কতটা সুন্দর করা সম্ভব সংস্কৃতির সম্পৃক্ততা ছাড়া। না কেউ কোনদিন পারেনি। ভবিষ্যতেও সে সুযোগ থাকবে না। এ কারণে বিদায়ী মেয়রের সাথে অতি সমৃক্ততার কথা ভেবে এর থেকে দূরে থাকার কোন সুযোগ নেই। তবে এ কথা নির্ধারিত ভাবেই সত্য যে, মেয়র সাদিক কিছু সংস্কৃতিক কর্মীদের যে পরিমান সাহচার্য্য দিয়েছেন তা বিস্ময়কর, অভাবনীয়। তেমনটার পুনরাবৃত্তির ভাবনা মূলত অলিক। যদিও তার বিনিময়ে তাদের তিনি ক্রয় করে নিয়েছিলেন তাদেরই অগোচরে। তাদের বানিয়ে ফেলেছিল সংস্কৃতির ঠিকাদার। যার ভয়াবহ পরিনাম ভোগ করছি আমরা এখন।
যার ফলশ্রুতিতে ইতিমধ্যেই সংস্কৃতিক নেতৃত্বের সম্ভবত প্রাসঙ্গিক বিবর্তীত পরিবর্তন ঘটেছে এই শহরে। অযোগ্য ক্ষমতলোভী প্রায় বিক্রি হয়ে যাওয়া সেই নেতারা এখন পথ খুঁজছেন নতুন পথের! যে পথ না জেনে না বুঝে পেতে রাখে রাজনীতি। আর যারা যথার্থ প্রতিবাদ করে, স্বকীয়তা নির্মাণে উদ্যেগী হয়, তাদের দিকে আঙ্গুল তুলে চরম ভন্ডরা বলে ‘ঐ যে পল্ডিবাজ আইছে।’ হাসি শব্দটিই তখন নিজের দিকে তাকিয়ে হাসে। তবু ঐ প্রতিবাদী
মানুষটি বলেনা এই শালা তুই বলবার কে, তুই তো সবথেকে বড় পল্ডিবাজ। এই দোষারোপের খেলায় এক সময় হারিয়ে যায় কঠিন সত্যগুলি।
তা না হলে কি করে সম্ভব, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্য জনসভায় বলে দেবার পরেও। শহর যাকে বলে মহানগর আওয়ামী লীগ। সেই তারা সবাই কি করে সাবেক মেয়রের নির্দেশে নিজেরা কেউ প্রার্থী না হওয়া সত্বেও নৌকা ফুটো করে দিতে সবাইকে ট্রাকে ওঠার নির্দেশ দিলো? ঘোষণা দিয়ে সবাই যখন নৌকায় তখন এই সিদ্ধান্তের ছোট করে অনেক বড় প্রতিবাদ করেছিল এসএম জাকির হোসেন। প্রকাশ্যে বলতে পেরেছেন কেন কিসের জন্য নৌকা ছাড়বো।
সেই অপরিনামদর্শী নির্দেশ যারা পালন করলো তারা কারা? কিসের বিনিময়ে সেই সকল সাংস্কৃতিক রাজনীতিক ও সামাজিক বেকুবরা নিজেদের সকল অর্জন বর্জন করতে প্রস্তুত হলো? জাকিরের এই প্রতিবাদ এখন জনমুখে প্রচলিত। যারা শুনতে পায় না ওরা, কারণ ওরা বধির। জাকিরের এই উচ্চারণ অনেক দিকপালের পক্ষেও করা সম্ভব হয় নাই। উল্টো চেষ্টা একে পল্ডি বলে চালিয়ে দেবার। এদের দলে এখন অনেকে। যাদের ধরে গাছে লটকিয়ে ওদেরে হাতে মুখে পায়ে কতবার পল্ডির দাগ সেটা গুনে গুনে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার। তা না হলে, অনবরত দুষ্ট ভন্ড তাবেদার নষ্ট মানুষগুলি কেবল মুখের জোরে আসন দখল করবে, আর আবুয়াল মাসুদ মামুনেরা অবাঞ্ছিত হয়ে কর্পোরেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে। যা শুরুতেই জনপ্রশ্নের মুখে ফেলবে সদ্য মেয়রকে।
যা দেখে প্রতিদিন নিরব উল্লাস করবে মেয়র সাদিকের কাছে চরম দলিত আমলাতান্ত্রিকতা। তা যদি সতভাগ সঠিক না হয়ে থাকে, তা হলে তাদের কথায় শতভাগ আনুগত্যতাও কোন যোগ্যতার কাজ নয়। নগরবাসী এ দুয়ের মেধাভিত্তিক সুসমন্বয় প্রত্যাশা করে। নয়তো মুখে কেবল গীত হবে বসন্তের গান, কোকিলের কন্ঠে কুহূতান। বাগানে বাগানে ফুটবে বাহারী রঙের ফুল কিন্তু নগরবাসীর বিশুদ্ধ নাকে পোঁছাবেনা তার শুদ্ধ শুবাস। চরম আশায় বুকবাধা মানুষের ঘরে ঘরে বাজবে হতাশার গীত ‘আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা!’
লেখক: আজমল হোসেন লাবু, সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ।