অগ্রসর অর্থনীতি আর উদীয়মান অর্থনীতির ১৯টি দেশ এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত অনানুষ্ঠানিক ফোরামের নাম জি-২০। এর ১৮তম শীর্ষ সম্মেলন সবে শেষ হলো নয়া দিল্লীতে। করোনা মহামারি, জলবায়ু পরিবর্তন আর ইউরোপে চলমান যুদ্ধের কারণে এবারের সম্মেলন স্বভাবতই বিশেষ আগ্রহ জাগিয়েছে। তার ওপর এবার সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেছে প্রতিবেশী দেশ ভারত।
জি-২০-এর সদস্য না হলেও বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশেষ আমন্ত্রণে এ সম্মেলনে অংশ নিয়েছেন। দুই দেশের আগ্রহেই সদ্য সমাপ্ত জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের পার্শ্বসভায় ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীদ্বয় বসেছেন মিনি সামিটে। পাশাপাশি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উৎসাহে নৈশভোজ ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে বিশ্বের প্রধান প্রধান শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে অনির্ধারিত আলাপ আলোচনার সুযোগ মিলেছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর। সাইড লাইনের এই কূটনীতির সদ্ব্যবহার করে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক পররাষ্ট্রনীতির সফল রূপায়নে সচেষ্ট ছিলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সহযোগীরা। সব মিলিয়ে এবারের জি-২০ সম্মেলনটি আগামী দিনগুলোর ভূ-রাজনৈতিক পথনকশা নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্ববহ হবে বলেই ধারণা পর্যবেক্ষকদের। বাংলাদেশের গণমাধ্যমেও এই সম্মেলনে দক্ষিণের জোটের সরব উপস্থিতির কথা বেশ ভালোভাবেই স্থান করে নিতে পেরেছে।
নিঃসন্দেহে বিশ্ব অর্থনৈতিক-কূটনীতির জন্য বর্তমান সময় ভীষণ বৈরি। শীর্ষ সম্মেলনের আগেই জি-২০-এর প্রস্তুতিমূলক সভা-মতবিনিময়গুলোতেই তার প্রতিফলন দেখতে পেয়েছি। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অগ্রসর, উন্নয়নশীল আর পিছিয়ে থাকা সকল অর্থনীতি ক্ষতির মুখে পড়লেও ভারতে অনুষ্ঠিত আগের একটি জি-২০ অর্থমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক থেকে এ বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছানোর খবর পাওয়া যায় নি। তবে অর্থমন্ত্রীদের সাম্প্রতিক সভা নির্বিঘ্নেই শেষ হয়েছে। তা সত্ত্বেও, সেপ্টেম্বর নাগাদ এই অনৈক্যের পরিস্থিতি খুব বড় রূপ নেয় নি। বরং ইউক্রেন যুদ্ধ বিষয়ে গ্রহণযোগ্য লাইনটি রেখেই সর্বসম্মতিক্রমে এই সম্মেলনের চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করা হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার, এ ধরনের বৈশ্বিক সঙ্কটকালে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য নীতি-প্রস্তাবনা হাজির করার জন্যই কিন্তু জি-২০-এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। বিশেষ করে ২০০৮-০৯-এর বিশ্ব আর্থিক সঙ্কট মোকাবিলায় জি-২০ সম্মেলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তাই এবারেও প্রাথমিক পর্যায়ে প্রত্যাশিত ফলা না পাওয়া নিয়ে হতাশ থাকা সত্ত্বেও, নতুন নতুন কৌশল নিয়ে এগুনোর পরিকল্পনায় সুদৃঢ় ছিলেন জি-২০ নেতৃবৃন্দ। ভারত ঠিক কৌশলই গ্রহণ করেছিল এই সম্মেলনে। সবাইকে একই মঞ্চে ধরে রাখার মুন্সিয়ানা দেখিয়েছে ভারত। এ প্রসঙ্গে ২০১৮ সালে কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং জি-২০-এর মূল প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম পল মার্টিনের একটি বক্তব্য মনে করা যায়। তিনি বলেছিলেন, ‘… জি-২০-এর লক্ষ্য হলো সকলের জন্য বিশ্বায়নের সুফল নিশ্চিত করা। … আর বিশ্বের রাষ্ট্রনায়ক আর মন্ত্রীদের যখন একটি বদ্ধ ঘরে একান্তে আলোচনার সুযোগ করে দেয়া হয় তাতে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার যে অমিত ক্ষমতা তৈরি হয় সে বিষয়টিও আমাদের মনে রাখতে হবে।’
আসলেই তাই। আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়েই বিশ্ব সঙ্কট সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করেছেন নেতৃবৃন্দ। চীন ও রাশিয়ার শীর্ষ নেতাদ্বয় না এলেও জি-২০ সম্মেলনের গুরুত্ব মোটেও কমে নি। বরং উপস্থিত সব নেতাই বিশ্ব শান্তি ও প্রগতির পক্ষে যৌথ সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হয়েছেন।
আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এবার বিশেষ আমন্ত্রণে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে গিয়েছিলেন। এর আগে দিল্লীতে ‘ইনোগরাল লিডারস সেশন’-এ ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কালে বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিরতা এবং করোনা মহামারির অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে একটি সুবিচারভিত্তিক ও ন্যায়সঙ্গত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সকলে একযোগে কাজ করার এখনই সময়।’
সদ্য সমাপ্ত সম্মেলনেও তিনি একই কথা বলেছেন। যুদ্ধের অবসান এবং বিশ্ব শান্তির পক্ষে কথা বলেছেন। হাতে হাত ধরে সকলকে সামনের দিকে হাঁটার আহ্বান জানিয়েছেন। এবারের জি-২০ সম্মেলনের মূল থিম ছিল : ‘এক বিশ্ব, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ (One World, One Family, One Future)’। এবার এ সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাঁর সরকার পশ্চিমের দেশগুলোর দিক থেকে ব্যাপক চাপ থাকা সত্ত্বেও রাশিয়ার সঙ্গে বৈরিতার পথে হাঁটেন নি। আবার একই সঙ্গে নরেন্দ্র মোদি রাশিয়ার প্রেসিডেন্টকেও জানিয়ে দিয়েছিলেন যে ‘এখন যুদ্ধের সময় নয়’। তাছাড়া তিনি একটি ভারসাম্যপূর্ণ বিশ্ব নেতৃত্বের ওপর বেশ জোর দিয়েছেন। একদিকে মহামারি আর যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক অস্থিরতা থাকলেও অন্যদিকে সকলে মিলে সমস্যা মোকাবিলার এমন আহ্বানও দৃশ্যমান ছিল। রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানি সরবরাহের সুবিধে নিয়ে ভারত পশ্চিমের কাছে খানিকটা প্রশ্নের মুখে থাকলেও তার চৌকষ কূটনীতির জোরে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমের অন্যান্য দেশগুলোর বিরাগভাজন হয় নি। ভারত বরং ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাড়তি মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। তাই খুবই সাবধানে তাকে কূটনীতির দাবার চাল দিতে হয়েছে। এমন কী চীনও এই সম্মেলনের চূড়ান্ত ইশতেহারে সন্তোষ প্রকাশ করেছে।
তবে একথা মানতেই হবে ভারতের রয়েছে খুবই সুদক্ষ একদল প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নেগোশিয়টর। তারা এই ভূরাজনৈতিক টানাপোড়েনের সময় খুবই চৌকষ দূতিয়ালির কাজটি করতে সক্ষম হয়েছেন। আর এই দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস. জয়শঙ্কর। তিনি এর আগে ভারত সরকারের পররাষ্ট্র সচিবও ছিলেন। অত্যন্ত দক্ষ, বুদ্ধিদীপ্ত এবং সাবধানী এই কূটনীতিক সবদিক সামলে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের সাফল্যকে এক নয়া মাত্রা দিতে সক্ষম হয়েছেন। বানারসে জি-২০ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সভায় তিনি যে দূরদর্শী বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন তাতেই প্রমাণিত হয় কতোটা বিচক্ষণতার সাথে তিনি তাঁর কূটনৈতিক কৌশলকে সফল করে চলেছেন। আর সে কারণেই এক সময় ভারত-বিদ্বেষী শতবর্ষী ঝানু মার্কিনী কূটনীতিক হেনরি কিসিঞ্জার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দক্ষতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। সবাইকে এক সঙ্গে রাখতে পারার জন্য তাঁকে সাধুবাদ জানিয়েছেন।
সত্যি বলতে দুই দশকেরও আগে জি-২০-এর শুরুটিই হয়েছিল বৈশ্বিক সঙ্কট মোকাবিলায় ছোট-বড় অর্থনীতির একযোগে কাজ করার ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে। গেল শতাব্দীর শেষ দশক থেকেই অনেকগুলো দেশই বিশ্ব অর্থনীতিতে উঠে আসতে শুরু করে ‘ইমার্জিং ইকোনমি’ হিসেবে। ঐ সময় সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও আর্থিক খাত বিষয়ে বহুজাতিক মঞ্চ হিসেবে ছিল জি-৭, যেখানে প্রতিনিধিত্ব ছিল শুধুই পশ্চিমের সাতটি উন্নত অর্থনীতির দেশের। তখনই আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোতে তুলনামূলক ছোট অর্থনীতিগুলোর প্রতিনিধিত্ব না থাকা নিয়ে ভাবিত ছিলেন অনেকেই। এই প্রেক্ষাপটেই এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে অর্থনৈতিক সঙ্কট শুরু হয়। রাশিয়া তার ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে সঙ্কটে পড়ে। অন্যদিকে ব্রাজিলেও মুদ্রার অবমূল্যায়নের ফলে সঙ্কট ঘনীভূত হতে থাকে। এই সঙ্কট মোকাবিলার নীতি-প্রস্তাবনাগুলো সকল পক্ষের আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতেই যেন দাঁড় করানো যায়- সে জন্যই জন্ম হয় জি-২০-এর।
বড় অর্থনীতির দেশগুলোর পাশাপাশি দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো থেকে প্রতিনিধিত্বশীল অর্থনীতির দেশগুলোকেও জি-২০-এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আন্তর্জাতিক ঋণের বিপরীতে দেয়া চার্জের হার কমিয়ে আনা, দরিদ্র দেশগুলোর জন্য আর্থিক সাহায্য নিশ্চিত করার মতো বেশ কিছু উদ্যেগসহ নানামুখী সংস্কারের যে নীতি-প্রস্তাবনাগুলো জি-২০ থেকে উঠে এসেছিল সেগুলো অনুসরণ করে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সঙ্কট সমাধানে সফলতা এসেছিল। সারা বিশ্বই এই অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক কূটনীতির সুফল পেয়েছিল। সেই ধারা আজও চলমান।
২০০৮ এবং ২০০৯-এ জি-২০-এর কার্যক্রমের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। মার্কিন হাউজিং মার্কেটে তৈরি হওয়া সঙ্কট তখন বিশ্বায়িত আর্থিক ব্যবস্থাপনার কারণে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে আগে মার্কিনীদের তরফ থেকে জি-২০-কে রাষ্ট্রনায়কদের সম্মেলনে রূপান্তরের যে অনাগ্রহ ছিল তা ওই সময়ে পরিবর্তীত হয়। ওই সময়ে (২০০৮-এ) বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লু. বুশের সভাপতিত্বে আর তার পরের বছর লন্ডনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পরপর দুটি জি-২০ সম্মেলন বিশ্ব অর্থনীতিকে বড় বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। সাধারণত বড় ধরনের অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখলেই বিভিন্ন দেশের সরকারগুলো নিজ নিজ অর্থনীতিকে আলাদাভাবে সুরক্ষা দিতে বিভিন্ন রকম সংরক্ষণবাদি নীতির (Protectionism) আশ্রয় নিতে শুরু করে। কিন্তু বিশ্বায়নের এ যুগে সংরক্ষণবাদ সমাধান হতে পারে না। ২০০৮-০৯-এ জি২০-এর কল্যাণেই সংরক্ষণবাদের সম্ভাব্য বিস্তারকে রোধ করা সম্ভব হয়েছিল বলে মনে করা হয়। এ প্রসঙ্গে জি-২০-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং সাবেক মার্কিন ট্রেজারি সেক্রেটারি লরেন্স সামার্স ২০১৮ সালে বলেছেন, ‘আর্থিক খাতের নিয়ম-নীতির সংস্কার এবং ভবিষ্যতে সম্ভাব্য সঙ্কট মোকাবিলায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সমন্বয় বিষয়ে ওই সময়ে ঐক্যমত্যে পৌঁছানো না গেলে, ঐ আর্থিক খাতের সঙ্কটের ভয়াবহতা বহুগুনে তীব্রতর হতে পারতো। …সে সময় জি-২০ খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিল।’
কাজেই দেখা যাচ্ছে জি-২০ প্রতিষ্ঠার প্রথম দশকের মধ্যেই অন্তত দুই বার বৃহৎ আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলার ক্ষেত্রে ত্রাতা হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। এই ট্র্যাক রেকর্ডের কারণেই বর্তমানে চলমান সঙ্কটেও এবারের জি-২০ শীর্ষ বৈঠক থেকে বিশ্ব সংকট মোকাবেলায় সম্মিলিত প্রয়াসের বার্তা পাওয়া গেছে। একবিংশ শতাব্দির তৃতীয় দশকের বৈশ্বিক বাস্তবতায় ভারত ‘হোস্ট কান্ট্রি’ হিসেবে তার কূটনৈতিক প্রভাব বেশ ভালোভাবেই প্রদর্শনী করতে পেরেছে বলা চলে। বৈশ্বিক অর্থনীতির কেন্দ্র এশিয়ার দিকে সরে আসার প্রেক্ষাপটে জি-২০-তে ভারতের সভাপতিত্ব ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। মনে রাখা চাই, রাশিয়া ভারতের পুরোনো মিত্র এবং এই সঙ্কটের মধ্যেও ভারতে জ্বালানি ও সার সরবরাহে তারা সহায়ক ভূমিকাই রেখেছে। অন্যদিকে পশ্চিমের বাজারও ভারতের জন্য দরকারি। পশ্চিমের কাছেও ভারতের বিকাশমান বাজারের গুরুত্ব অসীম। সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সফরে তা বেশ স্পষ্ট বোঝা গেছে। এ দুয়ের মধ্যে ভারসাম্য করাকে কেবল চাপ হিসেবে না দেখে নতুন দিগন্ত উন্মোচনের সুযোগ হিসেবেও বিবেচনায় নিয়েছে ভারত।
গণমাধ্যমের খবরে এবং বিশেষজ্ঞদের পর্যালোচনা থেকে জানা গেছে, পশ্চিমা বিনিয়োগকারীরা হালে চীন থেকে সরে এসে অন্যত্র বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন। ভারত দক্ষিণের জোটকে সাথে নিয়ে এই নয়া সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে আগ্রহী। তাই ‘ইমার্জিং ইকোনমি’র দেশগুলোর এমএসএমই খাতে বিনিয়োগ, এসব দেশের কৃষিকে বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনে আরও বেশি করে যুক্ত করা, এবং অগ্রসর অর্থনীতিগুলোর সাথে বাকিদের মধ্যকার দক্ষতার ব্যবধান (skills gap) কমানোর ওপর জোর দেবে দিয়েছে সরকার। একই সঙ্গে করোনার ধাক্কার পর পুনরুদ্ধারে মনোযোগের কারণে এসডিজি অর্জনের পথ থেকে যে বিচ্যুতি ঘটেছে সে ঘাটতি পুষিয়ে নেয়ার ওপরও বিশ্ব-নীতিনির্ধারকদের মনোযোগ আকৃষ্ট করেছেন নরেন্দ্র মোদি। অন্যদিকে ভারতসহ অন্য ‘ইমার্জিং ইকোনমি’গুলোতে জ্বালানি, আর্থিক সেবা খাতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের যে ঢেউ লেগেছে তাকে আরও বলশালি করতে বৈশ্বিক অংশীজনদের মধ্যে প্রযুক্তি বিনিময়ের ওপরও জোর দেয়া হয়েছে এবারের সম্মেলনে।
সবুজ জ্বালানী আতাত গড়া, মধ্যপ্রাচ্য-ভারত-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডর গড়ে তোলার মতো সুদুরপ্রসারি নীতিকৌশলের অনুঘটক হতে পেরেছে ভারত। সেই বিচারে এই সম্মেলনটি ছিল খুবই আশা জাগানিয়া। এ ছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তন আর নারী উন্নয়নের এজেন্ডাগুলোকেও আরও বেশি মাত্রায় আনার চেষ্টা করছে ভারত। অধিক ঋণে জর্জরিত দেশগুলোকে কি করে বিদেশি ঋণের পুনর্গঠন ও অবলোপনের সুবিধা দেয়া যায় সে বিষয়েও জি-২০-এর অর্থমন্ত্রীরা আলাপ চালিয়ে যাচ্ছিলেন বেশ কিছু দিন ধরে। এ ক্ষেত্রে এই কথাটিও বলা হচ্ছিল যে চীনের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে শ্রীলঙ্কা, জাম্বিয়া ও আফ্রিকার অনেকগুলো দেশেই চীনের ঋণ-নির্ভর বিনিয়োগের পরিমাণ যথেষ্ট। সেই ঋণ পরিশোধে দেশগুলো বেশ বিপাকেই পড়েছে। জি-২০ এর শীর্ষ সম্মেলনে ঋণ পুনর্গঠন নিয়েও কথা হয়েছে।
যে বিষয়টি বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে তা হলো- ভারত তার এই কল্যাণমুখী এজেন্ডা নিয়ে একা এগুতে চায় নি। ‘গ্লোবাল সাউথ’ বলে পরিচিত অপরাপর দেশগুলোর সমর্থনও তার দরকার ছিল। এখানেই বাংলাদেশের বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ পেয়েছে। দক্ষিণ এশিয়া থেকে একমাত্র বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকেই এই সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ভারত। তাছাড়া, জি-২০ সম্মেলনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আগে ভাগেই ছয়দফা প্রস্তাবনা উত্থাপন করেছিলেন। এগুলো হলো:
এক. বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে মানব সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের পথকে সুগম করা।
দুই. এসডিজির লক্ষ্যগুলোর পাশাপাশি বৈষম্য কমিয়ে আনার জন্য নতুন চিন্তা-ভাবনা শুরু করা
তিন. স্বল্পোন্নত দেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি হুমকির মুখে থাকা দেশগুলোর জন্য আলাদা তহবিল গঠন।
চার. চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে সারা বিশ্বে ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ কমিয়ে এনে নারীসহ সকলকে দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ।
পাঁচ. রোহিঙ্গা সঙ্কটের প্রেক্ষাপটে সকল মানুষের নিজ দেশে একটি সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন যাপনের অধিকারের প্রতি আরও বেশি সংবেদনশীলতা।
ছয়. প্রতিবেশী দেশ, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী, ব্যক্তিখাত, থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, এবং অন্যান্য অংশীজনদের সঙ্গে নিয়ে ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এই সম্মেলনে বিশ্ব নেতৃত্বকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী।
বিশ্বায়নের এই যুগে একবিংশ শতাব্দির প্রায় এক-চতুর্থাংশ পেরিয়ে এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়, পারস্পরিক সংঘর্ষ কিংবা সংরক্ষণবাদিতা নয়, গোটা মানব সভ্যতার টেকসই কল্যাণ আসবে পারস্পরিক সহযোগিতা ও সংবেদনশীলতা থেকেই। ঠিক এ রকম কথাই আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন জাতিসংঘে ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪-এ তাঁর ঐতিহাসিক বক্তৃতায়। সেদিন তিনি আশাবাদী উচ্চারণে বলেছিলেন, ‘… আমাদের পথ হইতেছে জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও যৌথ প্রচেষ্টা। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং সম্পদ ও প্রযুক্তিবিদ্যার শরিকানা মানুষের দুঃখ-দুর্দশা হ্রাস করিবে এবং আমাদের কর্মকাণ্ডকেও সহজতর করিবে, ইহাতে কোন সন্দেহ নাই। নতুন বিশ্বের অভ্যুদয় ঘটিতেছে।’
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘নতুন বিশ্বে’র দিকে একটি স্বার্থক পদক্ষেপ হিসেবে এবারের জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের মূল স্লোগান ‘এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ’ হিসেবে বিশ্বকে গড়ে তোলার সার্বিক আকাঙ্খার সাথে বাংলাদেশও যুক্ত থাকতে পেরেছে বলে আমরা গর্বিত। এই সম্মেলনে যুদ্ধ নয় শান্তির পক্ষে জোরালো বার্তা দিয়ে এসেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। এই শান্তি ও উন্নয়নের পথরেখা বিশ্ববাসীর মনে আরওস্পষ্ট হোক সেই প্রত্যাশাই করছি।
লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর