মার্কিন ভিসানীতি কতটুকু আইননিষ্ঠ?

নিকোলাস ম্যাকিয়াভেলির জগদ্বিখ্যাত বই ‘ইল প্রিনচিপে’। ইতালীয় ভাষায় রচিত বইটির অনূদিত নাম ‘দ্য প্রিন্স’। রাষ্ট্র-দার্শনিক ম্যাকিয়াভেলির মতবাদ অনুসারে একজন শাসক একচ্ছত্র অধিপতি হওয়ার জন্য সকল ধরনের নীতিগর্হিত পন্থা অবলম্বন করতে পারেন। পূর্বতন কয়েক শতকে রাজনৈতিক গৌরব অর্জনের আকাঙ্ক্ষাপ্রসূত ইউরোপীয় উপনিবেশিকতাবাদের যে কট্টররূপ আমরা দেখেছি তা মূলত ম্যাকিয়াভেলির এই মতবাদেরই প্রভাবদুষ্ট। শিয়ালের মতো ধূর্ততা হচ্ছে ম্যাকিয়াভেলিয়ান প্রিন্সের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তবে ‘লেজকাটা শিয়ালে’র গল্পও আমরা জানি। বিশ্বব্যাপী মার্কিন শাসননীতিকে সেই ম্যাকিয়াভেলিবাদের প্রতিবিম্ব বলা যায়। তবে শাসক হিসেবে মি. বাইডেন বিদেশি শক্তির সুনাম বৃদ্ধি প্রতিহত করার প্রচেষ্টা, বিশ্ব পর্যায়ে ক্ষমতাবান নেতৃত্বকে অবনমন করার চেষ্টা, সর্বোপরী অলিগার্কি বা কতিপয় ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি ক্ষুদ্র-গোষ্ঠীবাদী শাসনকাঠামো তৈরির পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে শিয়ালের মতো ধূর্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন যদিও তিনি সিংহের মতো সাহসী নন। আর অতিসম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের শাটডাউন শঙ্কা, ইউক্রেন যুদ্ধকে উস্কানি দিয়ে আবার রিপাবলিকানদের চাপে অর্থ জোগান থেকে পিছিয়ে আসাসহ বিভিন্ন দেশে ও ফোরামে মার্কিননীতি মুখ থুবড়ে পড়ায় বাইডেন প্রশাসনের অবস্থা লোককথার সেই ‘লেজকাটা শিয়ালে’র মতো হওয়ার উপক্রম।

 

সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার বৈশ্বিক প্রভাব বজায় রাখতে ভিসানীতিকে বারবার সামনে আনছে। যদিও বিশ্লেষকরা এটিকে ‘নতুন মোড়কে পুরোনো পণ্য’ হিসেবেই দেখছেন। যদিও জানি, মার্কিন ভিসানীতি বা স্যাংশন সব কিছুই তাদের আধিপত্যবাদী রাজনীতিরই একটা অংশ। তবুও বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে হচ্ছে। কারণ অতিসম্প্রতি বাংলাদেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বশীল প্রতিনিধি পিটাস হাস একান্ত একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সে-সাক্ষাৎকারে তার কথার মধ্য দিয়ে কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার মতো বিষয়ের উদ্রেক হয়েছে বলে আমি মনে করি। তিনি বলেছেন, ‘আগামীতে গণমাধ্যমের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে’ যা জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক।

সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় বলা হচ্ছে,  ‘Everyone has the right to freedom of opinion and expression; this right includes freedom to hold opinions without interference, and to seek, receive, and impart information and ideas through any media regardless of frontiers.’ তাছাড়া, একটি দেশ যখন অন্য একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের ওপরে নিজের ছায়া-নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সে দেশের গণমাধ্যমকেও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে তখন বিশ্বগণমাধ্যমের স্বাতন্ত্র্য অস্তিত্ব ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়। তাছাড়া এটি একটি খারাপ উদাহরণ হিসেবে দীর্ঘকালীন প্রভাব রেখে যায়।

 

শুধু কি তাই? এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাইডেন প্রশাসন নিজের দেশের সংবিধানকে লঙ্ঘন করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১ম সংশোধনী বলছে, ‘Congress shall make no law respecting an establishment of religion, or prohibiting the free exercise thereof; or abridging the freedom of speech, or of the press; or the right of the people peaceably to assemble, and to petition the government for a redress of grievances.’ একটি দেশের সংবিধান যখন সেদেশের সরকারের কাছে মর্যাদাসহকারে চর্চিত হয় না, তখন ভেঙে পড়ে সাংবিধানিক অনুশাসন; যা মঙ্গল-রাষ্ট্রের ধারণাকে প্রকম্পিত করে তীব্র আঘাতে। যদিও Reporters Without Borders-এর প্রতিবেদন বলছে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোর পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান।

গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার এক দাপ্তরিক বিবৃতিতে জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশের কতিপয় ব্যক্তিবর্গের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পদক্ষেপ নিচ্ছে বাইডেন প্রশাসন। যাদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে সেসব ব্যক্তি বা তাদের পরিবারের সদস্যরা হয়তো যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না [সূত্র : বিবিসি, ২২শে সেপ্টেম্বর ২০২৩]।

 

বিষয়টি এক ধরনের পররাষ্ট্রনৈতিক বালখিল্য। আবার অন্যদিক দিয়ে আন্তর্জাতিক আইন ও কনভেনশানকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের শামিল। কারণ International Humanitarian Law বলছে, ‘No person may be punished for acts that he or she did not commit. জেনেভা কনভেনশান ১৯৪৯ এই মৌলিক বিষয়টিকে আরও গভীর ও স্পষ্টভাবে বলছে, ‘The collective punishment of a group of persons for a crime committed by an individual is also forbidden, whether in the case of prisoners of war or of any other individuals [GCIII Art. 87, API Art. 75.2.d, APII Art. 4.2.b].’

এসব আইনের সারকথা হচ্ছে, একজনের অপরাধে অন্যজনকে শাস্তি দেওয়া যাবে না। অথচ বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য (যদিও বাইডেন প্রশাসন কারও নাম উল্লেখ করেনি), যাদের ওপরে মার্কিন ভিসানীতি প্রয়োগের কথা উঠছে, তারা তাদের জুরিসডিকশানের বাইরে কোনো দমনপীড়নমূলক কাজ করেছে কি না, ক্ষমতাসীন দলের কোনো রাজনীতিবিদ অসাংবিধানিক পন্থায় নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করছেন কি না সেটাই যেখানে আইনানুগ প্রক্রিয়ায় প্রমাণের বিষয়, সেখানে তাদের পরিবারের সদস্যদের ওপর জবরদস্তিমূলক শাস্তির ঘোষণা জারি আন্তর্জাতিক আইন ও বিধানকে আস্থা ও প্রয়োগযোগ্যতার সংকটে ফেলে দিয়েছে।

কথায় আছে— ভবিষ্যৎকে বুঝতে গেলে অতীতে যেতে হয়। তাহলেই সঠিক ধারণা পাওয়া যায়, সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কেমন হবে সেটি নিরূপণ হয়ে গেছে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়। সেসময় বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের বিপক্ষে গিয়ে দেশটি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের আশ্রয় ও প্রশ্রয়দাতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামে বীর বাঙালির দুর্ভেদ্য প্রতিরোধ ও দারুণ প্রতিঘাতে যখন মার্কিন রণকৌশল ও কূটনীতি বারবার ব্যর্থ হচ্ছিল তখন দেশটি খোলস ছেড়ে সম্মুখ রণনীতি গ্রহণ করে। ১০ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে পরমাণুশক্তিচালিত যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড়ো বিমানবাহী জাহাজ ‘এন্টারপ্রাইজ’ এবং ‘ডেস্ট্রয়ার’সহ আরও কয়েকটি জাহাজ ভারত মহাসাগরের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে; লক্ষ্য বঙ্গোপসাগর হয়ে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের এই সপ্তম নৌবহরনীতি ছিল মূলত পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সাহস ও শক্তি জোগানো এবং বীর বাঙালির মনে ত্রাস সৃষ্টি করার একটি রণনীতি। কী জানি, রাশিয়া এবং ভারতের নৌ-প্রতিরোধ না থাকলে মার্কিন এই নৌবহর হয়তো পাকিস্তানি নেভাল বেইজ হিসেবে বাঙালি নিধনে ব্যবহৃত হতো। তবে ত্রিশ লক্ষ শহিদ ও দুই লক্ষ মা-বোনের অসীম আত্মত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতার পবিত্রতম সূর্য যখন বঙ্গোপসাগর-বিধৌত হয়ে পূর্বদিগন্তে ওঠে তখন কোনো ষড়যন্ত্র, কোনো সমরতন্ত্র, কোনো নৌবহরনীতি সে সূর্যকে আর আড়াল করার ক্ষমতা রাখে না। নিক্সন প্রশাসনও পারেনি।

 

সময়ের বিবর্তনে নিক্সন প্রশাসন থেকে বাইডেন প্রশাসনে এসে মার্কিন সপ্তম নৌবহরনীতি আজ ভিসানীতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। তবে উদ্দেশ্য একটাই— একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ। সেজন্য নানা রকমের কূটচাল। তবে এ তৎপরতার শুরু বাহাত্তর সাল থেকেই। স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যেন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পায় সেই প্রচেষ্টা, বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের সময় বাংলাদেশগামী খাদ্যের জাহাজ আটকে দেওয়া, পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পেছনে প্রচ্ছন্ন ইন্ধন ও হত্যাকারীদের সেইফ-এক্সিট নিশ্চিতকরণ, পদ্মাসেতু রাজনীতিসহ উদীয়মান বাংলাদেশকে রুখতে গত পঞ্চাশ বছরে বহুমাত্রিক মার্কিন অপতৎপরতা আমরা দেখেছি। এ কথা সূর্যের মতো সত্য যে, স্বাধীনতার পরেও প্রতিনিয়ত বাংলাদেশকে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে যেমন লড়াই করতে হচ্ছে তার সঙ্গে আছে কতিপয় বিদেশি শক্তির নানামুখী কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির প্রবণতা। তবুও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে অনমনীয় গতি ও শক্তিতে। আজ বিশ্বদরবারে বাংলাদেশ একটি প্রতিনিধিত্বশীল ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের দর্শন ও রূপকল্প বিশ্ববাসীর ন্যায্য দাবি তথা বিশ্বশান্তির প্রতিফলন ঘটায়। মানুষের মানবিক অধিকার, মর্যাদা ও মুক্তির বার্তা নিয়ে বিশ্বসভায় বাংলাদেশ এখন বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশ কথার ফুলঝুরি ফোটানোয় বিশ্বাস করে না; রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিয়ে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাব মোকাবিলায় নেতৃত্ব দিয়ে আজ আমাদের দেশ— স্বয়ম্ভু বাংলাদেশ।

সুতরাং বাংলাদেশের ক্ষেত্রে মার্কিন ভিসানীতি ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মাত্রাতিরিক্ত হস্তক্ষেপ বাঙালির জাতিমর্যাদায় আঘাত হেনেছে। আমাদের স্বাধিকার ও সার্বভৌমত্বকে অশ্রদ্ধা করেছে। সুতরাং, বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে সমন্বিতভাবে এই দুষ্টাচারের প্রতিবাদ করা প্রয়োজন এবং ঐক্যবদ্ধভাবে অনাগত সকল ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা প্রয়োজন। বাঙালিয়ানার আত্মশক্তি ও আত্মমর্যাদায় নিজেদেরকে হতে হবে আরও বেশি সুদৃঢ়। পাশাপাশি, মার্কিন আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক পরিসরে জনমত যেমন গড়ে তুলতে হবে ঠিক তেমনই একটি কথা বিশ্বকে জানিয়ে দিতে হবে যে, বাংলাদেশ চলবে স্বসিদ্ধান্তে ও স্বনামে।

 

লেখক : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক  

Comments (০)
Add Comment